সেন্টমার্টিন দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ১০৬ আবাসিক হোটেল মালিককে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেন হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে ১৫ মে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের চট্রগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মাসুদ করিম লিখিতভাবে এ নির্দেশনা দেন।হোটেল মালিকদের দেয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের কারণ দর্শানোর নোটিশে বলা হয়েছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া ইসিএ এলাকায় হোটেল পরিচালনা করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ক্ষতি ও ইসিএ আইন এবং বিধি লংঘন,সেন্টমার্টিন দ্বীপের সংরক্ষিত এলাকায় হোটেল নির্মাণ করে অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি সাধন এবং দ্বীপের সমুদ্র পাড়ে লাইটিং এর মাধ্যমে কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর স্বাভাবিক জীবণ যাত্রা ও প্রজননে ব্যাঘাত করে দন্ডনীয় অপরাধ করছে হোটেল মালিকরা। তাদের এ ধরণের কর্মকান্ড ইসিএ বিধিমালা ও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনাও রয়েছে। তাই পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া হোটেল নির্মাণ ও পরিচালনা করা কেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবেনা তা আজ ১৫ মে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্রগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে কারণ দর্শনোর জন্য গত ২৪ এপ্রিল এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে হোটেল মালিকদের। অন্যথায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও পরিবেশ আদালত আইন অনুযায়ী মামলঅ দায়েরসহ অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্রগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মাসুদ করিম বলেন, যে কোন ভাবে দ্বীপটি রক্ষা করতে হবে। এ জন্য সবাইকে সহযোগীতার আহবান জানান তিনি।
এর আগে সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদন পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যেসব হোটেলকে স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিশ দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ময়নামতি রিসোর্ট, হোটেল সী ভিউ রিসোর্ট, শাহ জালাল রিসোর্ট, জারিফ রিসোর্ট, হোটেল সী প্রবাল রিসোর্ট, মার্মেট রিসোর্ট, গ্রিনল্যান্ড রিসোর্ট, ওশান ব্রু রিসোর্ট, একতা সেন্টমার্টিন রিসোর্ট, হোটেল দি ল্যাগন রিসোর্ট, হোটেল আইল্যান্ড প্রাসাদ, সেন্টমার্টিন প্রাসাদ, বে অব বেঙ্গল, হোটেল সী গোল গেস্ট হাউস, দেওয়ান রিসোর্ট, ফোর স্টার রিসোর্ট, হোটেল স্বপ্ন বিলাস রিসোর্ট, হোটেল ডলফিন রিসোর্ট, প্রিন্স হেভেন, প্রাসাদ প্যারাডাইস, হোটেল ফ্যান্টাসি, ব্রুু মেরিন রিসোর্ট-১, হোটেল সেন্টশোর, হোটেল সমুদ্র পুরী, হোটেল সী ব্রুু রিসোর্ট, রোজ মেরি রিসোর্ট, হোটেল রিয়াত গেস্ট হাউস, হোটেল আল বাহার, রিসোর্ট ব্রুু প্যারাডাইস, সেভেন স্টার রিসোর্ট, হোটেল সী হার্ট রিসোর্ট, রাজ মহল রিসোর্ট, রোকসানা রিসোর্ট, হোটেল সী-স্যান্ড রিসোর্ট, হোটেল সী ইন ইকো ভিলেজ, জল-পরি রিসোর্ট, স্বপ্ন প্রবাল রিসোর্ট, ফাহাদ রিসোর্ট, সি.টি.বি রিসোর্ট, ওশান ভিউ রিসোর্ট, সমুদ্র বিলাস, সান-সেড ভিউ রিসোর্ট, প্রবাল রিসোর্ট, হোটেল অবকাশ, হোটেল সালমা, সেন্টমার্টিন ডাক বাংলো, বে-ভিউ রিসোর্ট, সেন্টমার্টিন রিসোর্ট, শাহীন রিসোর্ট, হোটেল রোজ মেরী, ব্রু প্যারাডাইস, ব্যাটাস রিসোর্ট, ব্ল“ মুন রিসোর্ট, প্রবাল-দ্বীপ রিসোর্ট, রূপসী বাংলা রিসোর্ট, ব্রু সী ইষ্টান রিসোর্ট, সমুদ্র কানন রিসোর্ট, লাইট হাউজ রিসোর্ট, কোরাল ভিউ রিসোর্ট, রতœ দ্বীপ রিসোর্ট, সাইরি ইকো রিসোর্ট, কিংশুক রিসোর্ট, চন্দ্রবিন্দু রিসোর্ট, নীল দিগন্ত রিসোর্ট, সী ওয়াল্ড রিসোর্ট, বাগান বাড়ি রিসোর্ট, সমুদ্র কোটি রিসোর্ট, নীল সীমান্ত রিসোর্ট, নারিকেল বাগান রিসোর্ট, সীমানা পেরিয়ে রিসোর্ট, মায়া দ্বীপ রিসোর্ট, সমুদ্র বাড়ি রিসোর্ট, ব্রু লেগন রিসোর্ট, সেলার মুন রিসোর্ট, ড্রিম নাইট রিসোর্ট, পান্না রিসোর্ট, লাবিবা বিলাস (আবাসিক), ডায়ম- রিসোর্ট, রেহেনা কটেজ, নেট রিসোর্ট, সান সেট সেরেনিটি রিসোর্ট, জেন রিসোর্ট, ইকো রিসোর্ট, কোকোনাট কোরাল রিসোর্ট, মিউজিক রিসোর্ট, কোরাল ব্রু রিসোর্ট, ব্রু মেরিন রিসোর্ট-২, এস.কে.ডি আমার বাড়ি, সাউথ পয়েণ্ট রিসোর্ট, কক্স-বাংলা রিসোর্ট, জামাল ফোর কটেজ, নিউ আল বাহার কটেজ, ব্রু সী ইর্স্টান রিসোর্ট, মিউজিক রিসোর্ট, প্লাস কটেজ, সমুদ্র কুটির, ঢাকা কটেজ, হোটেল সাগর, ফাহাদ রিসোর্ট,লেডস শো গ্রিন, আবহাওয়া পর্যবেক্ষনাগার, আল সাইড কটেজ, জল নুপুর কটেজসহ ১০৬টি।
চলতি বছরের জানুয়ারীতে ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) নামে কক্সবাজারের স্থানীয় একটি পরিবেশবাদী সংগঠন সেন্টমার্টিনের হোটল-রিসোর্টের ওপর একটি জরিপ করে। সে জরিপে নির্মাণাধীনসহ ১০৬টি হোটেল-রিসোর্টের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। তারা কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে একটি আবেদন জমা দেয়। আবেদনে তারা জানায়, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি চলছে সরকারি স্থাপনার কাজ। তালিকাটি প্রকাশের পরপরই টনক নড়ে প্রশাসনের।ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, আদালতের সুষ্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা সেন্টমার্টিনে গড়ে উঠেছে হোটেল, মোটেলসহ নানা স্থাপনা। আদালতের নির্দেশ প্রদানের ৫ বছরেরও অধিক সময় অতিবাহিত হলেও আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী সেন্টমার্টিন ও এর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যর্থতা দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চরম অবজ্ঞা ও উদাসিনতার পরিচায়ক। একইসাথে আদালত অবমাননার সামীল।জানাযায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপে আদালতের নিষেজ্ঞা অমান্য করে স্থাপনা নির্মাণের বিষয়টি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আদালতের নজরে আনলে গত ২১ মার্চ হাইকোর্ট সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও নতুন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে ব্যর্থতায় চার সচিবসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন। তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার দায়ে কেন ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়। বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন। রুল জারি হওয়া বিবাদীরা হলেন- পরিবেশ ও বন সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব, মৎস্য ও প্রাণী স¤পদ সচিব, নৌপরিবহন সচিব, পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ও সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।বেলার আইনজীবী সাইদ আহমেদ কবির বলেন, ২০০৭ সালে কোস্টাল অ্যান্ড ওয়েটল্যান্ড বায়োডায়ভার্সিটি ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের এক জরিপে দেখা যায় সেন্টমার্টিনে ৭৪টি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। সেই জরিপের প্রেক্ষিতে এসব অবৈধ স্থাপনা অপসারণের নির্দেশনা চেয়ে বেলার পক্ষ থেকে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে জনস্বার্থমূলক একটি রিট দায়ের করা হয়। সেই রিটের শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২৪ অক্টোবর আদালত রায় দেন যে- পরিবেশগত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ছাড়পত্রবিহীন স্থাপনা অপসারণ করতে হবে। একসইঙ্গে ছাড়পত্রবিহীন নতুন কোন স্থাপনা নির্মাণ না করা ও বিরল প্রজাতির প্রাণী সংরক্ষণের নির্দেশও দেন হাইকোর্ট।আইনজীবী সাইদ আহমেদ কবির আরও বলেন, আদালতের সেই নির্দেশ সত্ত্বেও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি এমনকি তা ক্রমবর্ধমান রয়েছে। সে কারণেই বেলার পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়।