নাফাখুম! ভারী বর্ষণের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল নাফাখুমের পথ। এখন কিন্তু সেই বাঁধা নেই আর। সময় এসে গেছে দলবল নিয়ে বাংলার গর্ব, অপূর্ব সুন্দর এই জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার। তাই আজই ব্যাগ গুছিয়ে নিন, করে ফেলুন আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা! একটা চমৎকার দল নিয়ে নেমে পড়ুন পথে। নাফাখুমের অপার্থিব সৌন্দর্য আছে আপনারই অপেক্ষায়।
আপনার সুবিধার জন্য একটি খসড়া ভ্রমণ পরিকল্পনা তুলে ধরছি, সাথে থাকছে কিছু টিপস।
পথের খোঁজ:
নাফাখুম বান্দরবানের গহীনে লুকিয়ে থাকা চঞ্চলা এক জলপ্রপাত। আপনি যদি ঢাকা থেকে যেতে চান তাহলে বান্দরবানগামী যে কোনো বাসে উঠে পড়ুন। দূরের গন্তব্যে রাতের যাত্রাই উত্তম। তাই বেছে নিন রাত ৯ টা বা এর পরবর্তী কোনো বাস। বাস ভাড়া নেবে ননএসি বাসে ৬২০ টাকা এবং এসি বাসে ৯৫০ টাকা। বাজেট ট্রাভেলাররা ননএসি বাসই ব্যবহার করেন। তবে এসি বাসে পথের ক্লান্তি অনেক কম হয়। আপনার বাজেটের সমস্যা না থাকলে এই বাসেই যাতায়াত করতে পারেন।
বান্দরবান থেকে এবার যেতে হবে থানছি বাজার। পথে সব ঠিক থাকলে আপনি পাহাড়ের নিঝুম দেশ বান্দরবানে পৌঁছবেন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টায়। লোকাল বাসে চলে যেতে পারেন থানছি বাজার। বাসে থানছি যেতে চাইলে ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৯০ টাকা। বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট সময় আছে- বান্দরবান থেকে সকাল ৮টায় ছাড়ে প্রথম বাসটি। এরপর ১০.৩০টা, ১২.৩০ এবং ২.৩০ বাস ছেড়ে যায় থানছির উদ্দেশ্যে এবং থানছি থেকে সকাল ৮টা, ১০টা,১২টা, ২টায় পাবেন ফিরতি বাস। তবে যদি আপনার দল বড় হয় তাহলে যেতে পারেন চাদের গাড়িতে। সেক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। শংখ নদীর তীরের থানছি পৌঁছতে পৌঁছতে আর বান্দরবানের পাহাড়ি রূপ দেখতে দেখতে আপনি আবিষ্কার করবেন, ইতোমধ্যেই মন উচ্ছল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে সঁপে দিতে ইচ্ছে করছে। দুই পথেই আপনার সময় লাগবে ৪/৫ ঘন্টার মতো। তবে চান্দের গাড়ি যেহেতু রিজার্ভ নিচ্ছেন তাই বাড়তি সুবিধা হিসেবে নীলগিরি আর চিম্বুকও ঘুরে যেতে পারবেন।
বড়পাথর, তিন্দু! মায়াবি এক স্বর্গরাজ্য! ছবি: কালপুরুষ অপূ
থানছির পর এবার আপনার গন্তব্য রূপের রাজ্য রেমাক্রী। থানছি পৌঁছে প্রথমেই একজন গাইড ঠিক করুন। গাইড সমিতির কাছ থেকে রেজিস্টার্ড গাইড নেবেন। এজন্য সমিতিকে ফি দিতে হবে ১০০ টাকা এবং গাইডের ফি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, নির্ভর করছে কয়দিনের জন্য গাইড নিচ্ছেন তার উপর। বিজিবি ক্যাম্পে যেয়ে নিজের এবং দলের প্রত্যেকের তথ্য দিয়ে অনুমতি নেবেন। এসময় জাতীয় পরিচয়পত্র সাথে রাখুন।
রেমাক্রী যেতে হবে নৌকায়। এসময়টায় ইঞ্জিন বোট পাবেন। ভাড়া নেবে ৩-৪ হাজার টাকা। নদীর দু'দিকের জনপদ দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে যাবেন তিন্দু। নদীর জল, বড় বড় পাথর আর পাহাড় ঘেরা শ্যামল পরিবেশ তিন্দুর। এত মোহনীয় যে এখানে কিছু সময় না থাকলে অনেক সৌন্দর্যই না দেখা রয়ে যাবে। তিন্দুর রাজা পাথর দেখে আসুন, দেখুন পাথর রাজার সমগ্র পরিবার। আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই রাজাকে সম্মান জানাতে হয়। নইলে বিপদ ঘটে। আরও অনেক কিংবদন্তি জড়িয়ে আছে তিন্দুর পাথর রাজ্যকে ঘিরে। সে গল্প হবে আরেকদিন। আজ চলুন এগিয়ে যাই সামনে।
এরপর আবার নৌযাত্রা। পথে পড়বে আরেক চকিত কিশোরী ঝর্ণা রেমাক্রিখুম। রেমাক্রী পর্যন্ত যেতে যেতে প্রকৃতির যে শোভা চোখে পড়বে তা চোখ ধাধিঁয়ে দেবে দলের সবার। এ এক অনন্য সময়, যেখানে নেই কোনো হিংসা, বিদ্বেষ। আছে শুধু সুন্দরের সাথে সুন্দরের পবিত্র আলিঙ্গন।
নাফাখুমের পথে। ছবি: ঈথা চাকমা
রেমাক্রী পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। রেমাক্রীতেও বিজিবি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে নেবেন নিজেদের যাবতীয় তথ্য। পরদিন খুব ভোরে শুরু করুন নাফাখুমের পথে হাঁটা।নদী তীর ধরে, পিচ্ছিল পাথরের ওপর দিয়ে, কখনোবা বুক সমান পানি পেরিয়ে আপনাকে যেতে হবে নাফাখুম। পথটা কঠিন। মনে সাহস রাখুন। যতটুকু প্রয়োজন সময় নিন। যেকোনো প্রয়োজনে দ্বিধা না করে সাহায্য চান অন্যের কাছে। ধীরে এগিয়ে যান, তাড়াহুড়ো করতে যেয়ে বিপদ না ঘটানোই বুদ্ধিমানের কাজ। পথটা খুব দীর্ঘ মনে হলেও এক সময় ঠিক পৌঁছে যাবেন আরাধ্য স্থান নাফাখুমে। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না এমন নাফাখুমের রূপ দেখার পর মিটে যাবে সব ক্লান্তি।
এবার ফেরার পালা। এই রাতটাও থাকতে পারেন রেমাক্রীতে। কম খরচেই আদিবাসী ঘরে থাকতে পারবেন। সকালে আবার অপূর্ব নদীটি দেখতে দেখতে ফিরে আসুন থানছি।
দরকারি পরামর্শ-
১। ভ্রমণের আগেরদিন থেকেই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধক ঔষধ সেবন শুরু করুন।
২। বড় পলেথিন নিন, বিভিন্ন সময় আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস ভিজে যাওয়া থেকে মুক্তি পাবে এর মাধ্যমে।
৩। ব্যাগ হালকা রাখুন।
৪। কিছু সাধারণ ঔষধ, পেইন কিলার সাথে রাখুন। মশার জন্য ওডোমস নিতে পারেন।
৫। এই পথে জোঁকের সাথে সাক্ষাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। পায়ে মোজা পড়ুন। সাথে লবণ, তেল ইত্যাদি রাখুন।
৬। নিজেকে সতেজ রাখতে গ্লুকোজ, স্যালাইন পান করুন। তবে অল্প অল্প করে।
৭। ভালো গ্রিপের জুতা পরবেন অবশ্যই।
৮। প্রকৃতির মাঝে যেয়ে অবশ্যই প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করুন, ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকুন।