ফুকেট ভ্রমণ গাইডঃ কী কী করবেন আর কোথায় কোথায় যাবেন?
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবুন তো। কেমন লাগবে শুভ্র-সাদা সমুদ্রের পাড়ে বসে যদি একটা দুর্দান্ত সূর্যাস্তের দেখা মেলে? থাইল্যান্ডের ফুকেট ভ্রমণ এ পাবেন সেই শুভ্র-সাদা সমুদ্রসৈকতের দেখা। ফুকেটের সৌন্দর্য্য নিয়ে আসলে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই বিখ্যাত টুরিস্ট স্পটটি দুনিয়াব্যাপী ভ্রমণপিপাসুদের অত্যন্ত পছন্দের ঘুরতে যাওয়ার জায়গা।। এর এক একটি বীচ যেন এক এক টুকরো স্বর্গ। আপনি যদি কখনো ফুকেট গিয়ে থাকেন তবে জানবেন যে আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনা।
তাহলে শুরু করা যাক ফুকেটে গিয়ে কী কী করবেন আর কিছু দর্শনীয় স্থানের বিশদ বিবরণ। আমরা চেষ্টা করবো আপনাকে ফুকেট সম্পর্কে একটা পরিপূর্ন ধারনা দিতে যাতে আপনার জন্য ফুকেট ট্রিপটা সহজ ও সুন্দর হয়।
ফুকেট ভ্রমণঃ ফুকেট এ গিয়ে কী কী করবেন
কী কী করা যায় ফুকেট গিয়ে? আসুন দেখি-
এডভেঞ্চার
ফুকেট ভ্রমন যতটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগের জন্য ঠিক ততটাই নতুন নতুন এডভেঞ্চারে যোগ দেয়ার জন্য পারফেক্ট জায়গা। কী নেই এখানে! আপনি চাইলে সৈকতে বসে অলস সময় উপভোগ করতে পারেন আবার খোলা সমুদ্রে সুইমিং, স্নরকেলিং, সারফিং, র্যাফটিং, কায়াকিং, ক্লিফ জাম্পিং, কোয়াড বাইকিং, রক ক্লাইম্বিং, জিপ লাইনিং, কেবল স্কিইং, ওয়েকবোর্ডিং, ইত্যাদি রোমাঞ্চকর কার্যকলাপে যোগ দিতে পারেন।
স্নরকেলিং
রাতের ফুকেট
রাতের ফুকেটের চেহারা আবার অন্যরকম। রাতের ফুকেট যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে টুরিস্টদের। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রাতের ফুকেটে আছে নানান রকম প্রমোদ বিলাসের সুযোগ। এর মধ্যে পাতং-এর নাইট লাইফ বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য। পাতং এর বাংলা রোড ও প্যারাডাইস কমপ্লেক্স এ আছে অজস্র বার, নাইটক্লাব, ও ক্যাবারে যেখানে পারফর্ম করে শত শত এডাল্ট এন্টারটেইনাররা।
পাতং এর একটি ডিস্কো
ফুকেট শপিং
বিশ্বের প্রায় সব দেশের নামকরা ফ্যাশন হাউজগুলোর শোরুম এখানে আছে
ফুকেট যাবেন আর শপিং করবেন না? শপিং এর জন্য ফুকেট প্রসিদ্ধ। এখানে আছে থাই সিল্ক, ফুকেটের বিখ্যাত বিশুদ্ধ মুক্তো, আর থাই সারং। সারং থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় পোষাক। আরো আছে বীচে পরার স্যান্ডেল যাকে বলে ফ্লিপ ফ্লপস আর টী-শার্ট, সাবান, নারিকেলের খোসা দিয়ে তৈরি বাটি, ও হাতির আকৃতির শোপিস।
বিশ্বের প্রায় সব দেশের নামকরা ফ্যাশন হাউজগুলোর শোরুম এখানে আছে
থাই মেসাজ
থাই মেসাজের কথা এখানে না বললে অন্যায় হয়ে যাবে। ফুকেটের জায়গায় জায়গায় পাবেন এই বিখ্যাত থাই মেসাজ নেয়ার সুযোগ। এর একটা বড় গুণ হচ্ছে আপনার শরীরের সব ক্লান্তি দূর করে মনে প্রশান্তি এনে দিবে। ফুকেটের যে কোন মেসাজ পার্লারে গেলে মেসাজ থেরাপিস্ট আপনার শরীরকে দলাই মোচড়াই করে আপনার শরীর ও মনে নতুন আমেজ এনে দেবে। তাই ফুকেট গেলে এই সু্যোগ কোনভাবেই মিস করবেন না।
শরীরের ক্লান্তি মেটাতে থাই মেসাজের উপকারীতার কোন সীমা নেই।
ফুকেট ভ্রমণঃ ফুকেট এর কোথায় কোথায় যাবেন? ফুকেট দর্শনীয় স্থান গুলো কী কী? আসুন দেখি-
কোহ ফি ফি আইল্যান্ড (Koh Phi Phi Island)
আন্দামান সাগরে অবস্থিত কোহ ফি ফি ঈশ্বরের এক অপরুপ সৃষ্টি। এর ৯টি স্পট ঘুরে দেখার জন্য বোট ভাড়া করাই হবে সবচেয়ে উপযোগী। লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও’র মুভি “দ্যা বীচ”- এ প্রথম এই দ্বীপটি দেখানো হয়। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এখন ফুকেটে আসলে সব টুরিস্টরা অবশ্যই একবার কোহ ফি ফি ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোহ ফি ফি লেহ, মায়া বে, ফি ফি ভিউপয়েন্ট, ব্যাম্বু আইল্যান্ড, ভাইকিং কেভ ফি ফি আইল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত স্পট। এর মধ্যে মায়া বে এর কথা বিশেষভাবে উল্ল্যেখযোগ্য।
কোহ ফি ফি তে ঘুরে বেড়ানোর সময় খেয়াল করবেন আপনার পায়ের নীচের বালিগুলো অন্য সব সৈকতের চেয়ে তুলনামূলক নরম। কোহ ফি ফি ঘুরে দেখার জন্য সাধারনত একদিনের একটি ট্যুরই যথেষ্ট। কেউ রাতে থাকতে চাইলে এখানে অনেক অভিজাত হোটেল, রিসোর্ট ও সুইমিং পুল সহ প্রাইভেট ভিলা আছে। মু ডি বে তে স্নরকেলিং করতে ভুলবেন না। এখানে শার্ক-ওয়াচিং, রক ক্লাইম্বিং ও ক্লিফ জাম্পিং এর ও সুযোগ রয়েছে। এখানকার মানুষগুলো অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ ও অতিথিপরায়ন।
কোহ ফি ফি আইল্যান্ড
ফ্যাং না বে (Phang Nga Bay)
বিখ্যাত জেমস বন্ড আইল্যান্ড প্রথম দেখানো হয় ১৯৭৪ সালের জেমস বন্ড মুভি “ দ্যা ম্যান উইথ দ্যা গোল্ডেন গান” এ যেখান থেকে পরবর্তীতে এর নামকরণ হয়। এটি এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। জেমস বন্ড আইল্যান্ড ফ্যাং না বে থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত।
জেমস বন্ড দ্বীপ দেখার পর ট্যুরিস্টরা সাধারণত কোহ পানিয়ে (Koh Panyee) গ্রামে যায় দুপুরের লাঞ্চ বা হালকা খাবার খেতে। এই গ্রামটি সীফুডের জন্য বিখ্যাত। আরো একটি কারণে এটি বিখ্যাত। সেটি হচ্ছে এর অবস্থান। পুরো গ্রামটি পানির উপর ভাসমান পিলার এর উপর অবস্থিত। এটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। এখানে একটি সুন্দর ভাসমান মসজিদ ও ফুটবল খেলার মাঠ ও রয়েছে।
সামেত নাংশি ভিউপয়েন্ট ( Samet Nangshe Viewpoint) ফ্যাং না বে’র আরেকটি আকর্ষণ। এখান থেকে ফুকেটের ৩৬০-ডিগ্রী প্যানারোমা ভিউ পাওয়া যায় যা অনেকদিন মনে থাকার মতো। এটি ফুকেট থেকে মাত্র ৩০-মিনিটের কার রাইড দূরত্বে অবস্থিত। এখানে সুন্দর বোটিং এর ব্যাবস্থা আছে। এখানকার আরেকটি বিশেষত্ব লাইমস্টোনের খাড়া পাহাড়গুলো।
ফ্যাং না বে
পাতং (Patong)
ফুকেটের সবচেয়ে সুন্দর, নিরিবিলি ও শান্তিময় সমুদ্রসৈকতগুলো পাতং এ অবস্থিত। তাই বীচ-লাভার রা এখানে নিয়মিত আসে। এখানকার শুভ্র-সাদা সমুদ্র সৈকতগুলো সমুদ্রপারে বসে একটি আদর্শ অলস দিন কাটানোর জন্য আদর্শ। এখানে আরো আছে একা অথবা কাপল স্পা মেসাজ, বীচ ভলিবল, বীচ ফুটবল, স্নরকেলিং ইত্যাদিতে অংশ নেয়ার সুযোগ। আপনি চাইলে হাইকিং, ক্যাম্পিং, গলফ, বা মাউন্টেইন বাইকিং ও করতে পারেন।
পাতং বিখ্যাত এর রাতের বিনোদন-ব্যবস্থার জন্য। রাত্রিবেলায় পাতং জুড়ে বসে বার, ক্যাফে, নাইটক্লাব, ডিস্কো, ক্যাবারে, ও ক্যাসিনো’র পসরা। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পাতং হতে পারে বিনোদনের আধার।
পাতং এর শান্ত সৈকত
বড় বুদ্ধ ( The Big Buddha)
৪৫-মিটার লম্বা ও ২৫-মিটার চওড়া জেড মার্বেলে তৈরি ফুকেটের সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি অবস্থিত ওয়াত কাতা (Wat Kata) মন্দিরে, নাগা হিলের ওপর। এটি ভ্রমণপিপাসুদের কাছে একটি প্রিয় জায়গা কারণ এখান থেকে পুরো ফুকেট শহর দেখা যায়। মন্দিরটিতে বড় বুদ্ধ ছাড়াও আরও ছোট ছোট স্বর্ণালী বুদ্ধমূর্তি আছে। মন্দিরে যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পরিমাণে শরীর ঢাকতে ভুলবেন না।
বড় বুদ্ধ
ফুকেট এ ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ সময় কখন?
ফুকেটে যাওয়ার আদর্শ সময় ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে কারণ তখন আবহাওয়া সবচেয়ে ভালো থাকে। এমনিতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়ার কারণে ফুকেটে সারা বছরই সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া যায়। তাই পশ্চিমারা শীতকালে ফুকেট চলে আসে একটু উষ্ণতার খোঁজে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হলেও অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠে যায়।
কোথায় কোথায় থাকবেন ফুকেট এ গিয়ে?
থাইল্যান্ডের ট্যুরিস্ট প্রধান শহর ফুকেট। এখানে ট্যুরিস্টদের থাকার জন্য সব ধরণের ব্যবস্থা বিদ্যমান। অভিজাত হোটেল আর রিসোর্ট যেমন আছে তেমনি আছে বাজেট ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সাশ্র্যয়ী মাঝারি মানের হোটেল। প্রাইভেট ভিলা যেমন আছে তেমনি আছে স্টুডেন্ট দের থাকার উপযোগী হোস্টেল। ফুকেটের হোটেলগুলো বিশ্বমানের। তাই আপনি এখানে পাবেন বিশ্বমানের সেবা ও আরাম। যেখানেই থাকুন না কেন, নিশ্চিত করুন যে আপনার রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায় কারণ রুম থেকে সমুদ্র দেখার অভিজ্ঞতার কোন তুলনা হয়না।
কী কী খাবেন ফুকেট এ গিয়ে?
খাবার যেকোন ট্রিপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন বিষয়। আপনি যদি প্রথমবারের মতো ফুকেট যেতে চান তবে জেনে রাখুন ফুকেট এর খাবার আপনাকে নিরাশ করবে না। এখানে সবচেয়ে মজা রাস্তার পাশের স্ট্রিট ফুড গুলো। সৈকত থেকে স্নান করে ফেরার পর আপনার ক্ষুধার্ত পেট কে শান্তি দিতে ঢুকে পড়তে পারেন বীচের পাশের ছোট ছোট দোকানগুলোতে। তাতে ক্ষুধা নিবারণ ও হবে আবার থাইল্যান্ডের স্থানীয় খাবার চেখে দেখার ও সু্যোগ হবে।
শুধু স্থানীয় খাবারই নয়, ফুকেটে রয়েছে সব রকম খাবারের পশরা। চাইনিজ, জাপানিজ, এশিয়ান থেকে শুরু করে মজার মজার সামুদ্রিক মাছের পরিবেশনা। কী নেই এখানে! ফুকেট এর কিছু বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট এর নাম – লেম সাই সীফুড (Laem Sai Seafood) , ক্রোয়া পাইলিন (Kroa Pailin), রোটি চাওফা (Roti Chaofa), রায়া (Raya), দ্যা চার্ম ডাইনিং গ্যালারী ( The Charm Dining Gallery) ও নাম ওই ( Nam Yoi)।
ওল্ড ফুকেট টাউনের ওল্ড ওয়ার্ল্ড চার্ম মিস করবেন না। এখানে আছে পুনরুদ্ধারকৃত কিছু রেস্টুরেন্ট ও ক্যাফে যা আপনাকে নিয়ে যাবে শতবর্ষ পুরোনো থাইল্যান্ডে ।
ফুকেটের খাবার
ফুকেট ভ্রমণ সংক্রান্ত কিছু কথা
ফুকেটের উদ্দেশ্যে প্লেনে ওঠার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মাথায় রাখতে হবে। প্রথমতঃ যেখানে যাচ্ছেন সেখানকার মানুষ ও তাদের সংস্কৃতিকে সম্মান করতে হবে। এমন কোন আচরণ করা যাবে না বা কথা বলা যাবে না যেটা সেখানকার মানুষের কাছে অপমানজনক মনে হয়। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলুন এবং মেশার চেষ্টা করুন। দেখবেন অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে। সর্বোপরি, মৌলিক শিষ্টাচার বজায় রেখে চলুন যেমন পা দিয়ে কিছু দেখাবেন না এবং কোন থাই ব্যক্তির মাথায় হাত দেবেন না। পাবলিক প্লেসে কাপড় বদলাবেন না এবং মন্দিরের সম্মান রক্ষা করুন।
শেষ কথা
আশা করি আপনাদের এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে ফুকেট ভ্রমণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানাতে পেরেছি। যদি আপনার এই আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকে তাহলে আমাদের অন্য ব্লগ গুলোও পড়তে পারেন।