স্টার ওয়ার্স এর সিকুয়েল “দ্যা লাস্ট জেডাই” সিনেমাটি দেখেছিলেন? সিনামাটিতে দেখানো এই এলিয়েন গ্রহের জায়গাটি কি নিতান্তই কম্পিউটারে বানানা?? নাকি পৃথিবীতেই এমন কোন জায়গা রয়েছে? সিনেমাটির এসব দৃশ্যের শুটিং করা হয়েছিল “সালার দে উয়ুনি” বা সালার দে তুনুপার ( “Salar de uyuni” )নামক স্থানে যা বলিভিয়ার দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলে সাড়ে দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে আন্দিজ পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তৃত । সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে জায়গাটির উচ্চাত প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। এই জায়গাটিতে গোটা বিশ্ব থেকে ছুটে আসে দলে দলে পর্যটক আর ফটোগ্রাফার। কেন? জানাচ্ছেন ইমন সরকার...
জায়গাটি ভীষণ সমতল এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় জায়গাটিকে আদর্শ সমতল হিসেবে ধরা হয়। বৃষ্টি হলে পানি দিগন্ত জুড়ে সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। তৈরি হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আয়না, দেখলে মনে হয় যেন পুরো আকাশকে প্রতিফলিত করছে। “সালার দে উয়ুনি” রাতের বেলায় আরো বেশি মনমুগ্ধকর পুরো আকাশ যেন গলিয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে!
জায়গাটি মূলতঃ একটি বিবর্তিত লোনা জলের লেক। উপরে জমেছে কয়েক মিটার পুরু লবনের স্তর। নিচেই রয়েছে ঘনীভুত লবনের পানি, যা ব্রাইন নামে পরিচিত। অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, শুধু লবণের টানেই আজ সালার দে তুনুপার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। গোটা অঞ্চলকে আসলে লবণে ঢাকা একটি সমভূমি বলা চলে। আন্দাজ ১০ বিলিয়ন টন লবণ মজুদ রয়েছে এখানে। কিভাবে এমনটা সম্ভব হলো?
প্রায় ৩০ বা ৪০ হাজার বছর আগের কথা। এলাকাটা ছিল মিঞ্চিন নামের এক বিশাল হ্রদের নিচে। নানা ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের চক্করে পড়ে একসময় প্রায় গোটা এলাকা শুকিয়ে যায়। রেখে যায় শুধু পোপো আর উরু উরু নামের ছোট দুটি পৃথক হ্রদ এবং সালার দে কোইপাসা ও সালার দে ইয়ুনি নামের দুটি লোনা জমি। এর মধ্যে সালার দে উয়ুনি আকারে বড়।
শুকনো মৌসুমে গোটা এলাকা ধবধবে সাদা লবণের চাদরে মোড়া থাকে। আর বর্ষাকালে পোপো হ্রদের পানি উপচে পড়ে লবণের জমি দুটি ভাসিয়ে দেয়, তৈরি করে এক অপূর্ব দৃশ্যের। এর মধ্যেই আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে ছোট্ট ছোট্ট ‘দ্বীপ’। লবণের কারণে তেমন প্রাণবৈচিত্র্য নেই। তবে মাঝেমধ্যে দেখতে পাওয়া যায় আন্দিজ শিয়াল আর বর্ষা মৌসুমে পর্যটকের পাশাপাশি অসংখ্য ফ্লেমিঙ্গোদের আগমন ঘটে । এখানে লবণাক্ত পানিতে জন্মানো শেওলা আর ব্রাইন চিংড়ি এদের প্রিয় খাবার। এদের দেহের রঙ মূলতঃ সাদা হলেও শেওলা- চিংড়ির রঞ্জকের প্রভাবে পালক গুলো রক্তিমবর্ণ ধারণ করে। এছাড়া বিরান ভূমিজুড়ে ছড়িয়ে আছে ক্যাকটাস আর অল্প কিছু কষ্টসহিষ্ণু ঝোপঝাড়।
লবণাক্ত অঞ্চলটিতে লবণ ছাড়াও রয়েছে হরেক রকমের খনিজ সম্পদ। বিশেষ করে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, লিথিয়াম আর ম্যাগনেসিয়ামে সমৃদ্ধ। বিদেশি কম্পানিকে বলিভিয়া সরকার এই মজুদে ভাগ বসাতে দিতে রাজি নয়। তাই দেশীয় প্রযুক্তিতে সামান্য কিছু খনিজ উত্তোলন করা হয়ে থাকে। এখানকার লবণাক্ত জমি থেকে ফি বছর উত্তোলন করা হয় প্রায় ২৫ হাজার টন লবণ।
সালার দে উয়ুনি পর্যটকদের খুব পছন্দের এক জায়গা। কাছেপিঠে বড় কোনো শহর নেই, কাজেই এখানেই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু হোটেল। এসব হোটেলের অনেকই আবার বানানো হয়েছে লবণ দিয়ে। ১৯৯৫ সালে হোটেল দে সাল প্লায়া দিয়ে শুরু, তারপর একে একে অনেকগুলো লবণে নির্মিত হোটেল গড়ে উঠেছে এখানে। সেগুলোর দেয়াল বা ছাদ থেকে শুরু করে আসবাবপত্র পর্যন্ত তৈরি হয়েছে স্রেফ লবণ দিয়ে।
আসা যাক সবচেয়ে জনপ্রিয় হোটেল প্যালাসিও দে সালের কথায়—এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০৭ সালে। ১০ হাজার টন খাঁটি লবণ দিয়ে বানানো এই ‘লবণাক্ত’ হোটেলে আপনি আধুনিক সব কিছুই পাবেন। নিজস্ব বার, পুল খেলার জায়গা, সুইমিংপুল আর অতি অবশ্যই লবণাক্ত পানিতে গোসল করার ব্যবস্থা, এমনকি নিজস্ব লবণাক্ত গলফ কোর্স পর্যন্ত রয়েছে এখানে। সাড়ে চার হাজার বর্গফুটের এই হোটেলে ওয়াই-ফাই সুবিধা থেকে শুরু করে সবই পাবেন, তবে একটাই শুধু নিষেধাজ্ঞা—দেয়াল বা অন্য কোথাও চেটে দেখা চলবে না। লবণে বানানো হোটেল বলে কথা! পর্যটকরা মাঝেমধ্যেই চেটে নিশ্চিত হতে চান, আসলেই সব কিছু লবণে বানানো নাকি। দুজনের একটা রুমে এক রাত থাকার জন্য ভাড়া গুনতে হবে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার টাকা। ৪৮ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
অনুমিতভাবেই প্রতিবছর বর্ষাকালে হোটেলের অনেক অংশ বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে চলে যায়। তবে দ্রুতই আবার সেটি মেরামত করে ফেলা হয়। লবণাক্ত হোটেলে এক রাত পার করার জন্য এটুকু ঝঞ্ঝাট পোহাতে অবশ্য কারোরই তেমন আপত্তি থাকে না। লবণে বানানো হোটেলে থাকতে আর ধবধবে বিরান লবণের ‘মরুভূমি’ দেখতে সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন বলিভিয়ার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
সবকিছু মিলিয়ে “সালার দে উয়ুনি” প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের এমন এক লীলাভুমি যা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়।